আমি ডক্টর বিশ্বরূপ, তোমাদের কাছে আমি পাপু নামেই বেশী পরিচিত । আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে আমি হাওড়া জেলার দামোদর নদীর ধারে ছোট্ট একটি গ্রামে ( জানবার) জন্মেছিলাম । সেই গ্রামের জল , হওয়া , মাটি, মাখতে মাখতে আজ আমি জীবনের অনেকটা বসন্ত কাটিয়ে একজন ছোটখাটো ডাক্তার হতে পেরেছি । আমাদের সময় এত ইংরাজি মাধ্যম, নার্সারি বিদ্যালয় এর প্রচলন ছিলো না। আমার শ্রীকৃষ্ণপুর বাগপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার হাতেখড়ি , সে সময় ওখানে বেশ কয়েকজন ভালো বন্ধু (চন্দন, সুব্রত, চিন্ময়), সিনিয়র দাদার ( শান্তি পাখিরা, অশোক বর)সান্নিধ্যে এসেছিলাম । ভালো বন্ধুদের সাথে সুস্থ প্রতিযোগিতা (সেই প্রতিযোগিতা ১২ ক্লাস পর্যন্ত বজায় ছিল )আমায় ডাক্তার হতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল । সেই সুস্থ প্রতিযোগিতা না থাকলে হয়তো আজ আমি ডাক্তার হতে পারতাম না😂 । কালের নিয়মে সেই প্রাথমিক স্কুলের সিনিয়র রা আমার জীবন থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। কিন্তু এমন একটি স্মৃতি না বললেই নয় আজ বলি——- আমি কাঠি বরফ খেতে খুব ভালোবাসতাম ।বাবা মা সেভাবে পয়সা দিত না স্কুলে যাবার সময় । ফলে স্কুলে গিয়ে বরফ ওয়ালার কাছে গিয়ে মুখ বেজার করে দাড়িয়ে থাকতাম । তখন ওই শান্তিদা আর অশোকদা প্রায় তথাকথিত কাঠি বরফ কিনে আমায় আগে কিছু টা খেতে দিত , তারপর নিজেরা খেতো । এ রকম ভালোবাসা আজকালকার দিনে ভাবাই যায় না । তবে এই করোনা মহামারীতে আমি ডাক্তার হিসাবে বলব একজনের মুখের খাবার অন্য জনের খাওয়া ঠিক নয় । কিন্তু আমি এখানে এই ঘটনাটা উল্লেখ করলাম শুধুমাত্র অনুজদের প্রতি অগ্রোজদের ভালোবাসা উল্লেখ করার জন্য । আর প্রাথমিক স্কুলে যে দুজনের কথা না বললে আমার ডাক্তার হওয়া হয়ে উঠতো না তারা হলেন আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক(নিমাই অধিকারী) আর চিত্তবাবু(যিনি সকলের কাছে জান মাস্টার নামেই সমধিক পরিচিত) । এই দুজন মাষ্টারমশাই ছিলেন স্কুল এর স্তম্ভ, একে একজনের পরিপূরক । এই ছোট্ট বাংলা মাধ্যমের স্কুল টি বলতে পারো আমার শিক্ষার ভীত তৈরী করে দিয়েছিল । আর একজনের কথা না বললে আমার প্রাইমারি শিক্ষার ভীত অসমাপ্ত থাকতো তিনি হলেন আমার গৃহশিক্ষক শিখা দিদিমণি, কি মারটাই না মারত আমায় ছোটবেলায় পড়াশোনা না করলে । সেই দিদিমণির অকাল মৃত্যু আমায় খুবই দুঃখ দিয়েছিল। এরপর সময় এর সাথে সাথে এই স্কুল ছেড়ে উচ্চ প্রাথমিক স্কুল( শ্রীকৃষ্ণপুর চিত্তরঞ্জন হাই স্কুল) এ ভর্তি হলাম।
শ্রীকৃষ্ণপুর হাই স্কুলে আমার সাথে ভর্তি হলো আমার দুই বন্ধু , যাদের সাথে প্রাইমারি স্কুলে একটা সুন্দর প্রতিযোগিতা হতো , সেই চন্দন আর সুব্রত! বড় স্কুল তাই প্রথম দিকে ধুতরো ফুল দেখতাম , প্রথম দিকে আমরা তিনজনেই পিছিয়ে পড়লাম পরীক্ষায় । এই ভাবেই পঞ্চম শ্রেণী থেকে সোস্থ শ্রেণীতে উঠলাম । তারপর মোটামুটি রেজাল্ট করে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত উঠলাম। তারপর এমন একজন শিক্ষক এর সান্নিধ্যে এলাম যিনি আমায় গণিত বিষয়ে বিশেষ ভাবে পারদর্শী করে তুলেছিলেন, যার হাতে পরে আমার প্রভূত উন্নতি হয়েছিলো, তিনি আমার শ্রদ্ধেয় সবার পরিচিত দুর্গা বাবু । বলা যায় যার হাত ধরেই আমার উচ্চ শিক্ষার প্রাথমিক সোপান তৈরি হয়েছিল । আর একজনের ভূমিকা আমার জীবনে অনেকটাই জায়গা দখল করে রেখেছে তিনি আমার প্রিয় ইংরাজি শিক্ষক দীপক প্রধান, যে মানুষ টাকে এই স্কুল এর ছাত্ররা তো বটেই এমনকি অভিভাবকরা পর্যন্ত ঠিকঠাক মূল্যায়ন করতে পারে নি । সত্যিই মানুষটি বড় গুণী মানুষ ছিলেন , তার যথাযোগ্য মর্যাদা আমরা এখনো পর্যন্ত দিতে পারিনি, হয়তো সেই অভিমানে স্কুল এর তরফ থেকে অবসরকালীন ফেয়ারওয়েল নিতে অস্বীকার করেন । এই ঘটনা স্কুল এর প্রাক্তন হিসাবে আমাকে আজও পীড়া দেয় । জীবনে যদি কখনও সুযোগ আসে চেষ্টা করবো কিছুটা হলেও সেই ঘটনার প্রায়শ্চিত্ত করতে । যাই হোক অন্যান্য শিক্ষক দেরও কাছে কৃতজ্ঞ , যারা না থাকলে হয়তো আজ আমার ডাক্তার হয়ে ওঠা হতো না । যাই হোক এই স্কুল জীবনের শেষ দিকে একটাই দুঃখ ছিল শেষ কুইজ প্রতিযোগিতায় আমাদের টিম (আমি , চন্দন, সুব্রত) চ্যাম্পিয়ন হতে পারলো না , জুনিয়র দের কাছে ১/২ পয়েন্টে হেরে গিয়ে রানার্স হয়েছিলাম । যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমাদের জোর করে হারানো হয়েছিলো, সেদিন খুব রাগ হয়েছিলো🥸🥸। যাই হোক সব ভালো যার শেষ ভালো এই কথাটা বোধহয় ওপরওয়ালা আমাদের জন্য ভেবে রেখেছিল মনে মনে । তাই মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনজনেই স্টার পেলাম, সুব্রত প্রথম, চন্দন লাস্ট স্টেজে আমায় টপকে দ্বিতীয় , আর আমি সবার শেষ তৃতীয় স্থান দখল করলাম । প্রত্যেকেই গণিতে ৯০ এর অধিক নাম্বার পেয়েছিলাম। সেদিন যে কি আনন্দ পেয়েছিলাম তা আমিই জানি । তারপর এদিক ওদিক থেকে তিনজনেই টুকটাক সম্বর্ধনা পেয়ে ভালো রেজাল্ট করার খিদেটা আরও জাকিয়ে বসলো ।
এরপর শুরু হলো উচ্চমাধ্যমিক স্কুল এ ভর্তি হওয়া । ভর্তি হলাম তেঁপুর নবাসন উচ্চ বিদ্যালয় । যেহেতু এই স্কুল এ মাত্র দুবছর কাটিয়েছি তাই এই স্কুল এর সাথে আমার সেভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি। যেহেতু এই স্কুল এ যারা ভর্তি হয়েছিল তাদের ৮০শতাংশ স্টার পাওয়া ছেলে , তাই আমি প্রথম দিকে হীনমন্যতায় ভুগতাম । তারপর কো এড স্কুলে পড়ার সময় মেয়েদের সাথে কথা বলার সময় তটলাতাম, সে যা টা অবস্থা 😂😂😂😂 । তারপর একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় গণিতে আরও ভয়াবহ রেজাল্ট মাএ ২১!(১০০এর মধ্যে, সর্বোচ্চ ৩৮!)। যাই হোক উচ্চ মাধ্যমিক দিলাম কেমিস্ট্রি, ইংরাজি দূর্দান্ত দিলাম (পরে বলছি কতটা দুর্দান্ত দিলাম) । সব পরীক্ষার শেষে কাটাছেঁড়া শুরু হলো! কিসে কত পেতে পারি, যা হিসাব করলাম কেমিস্ট্রি তে লেটার , ইংলিশ এর দ্বিতীয় পত্রে লেটার পাচ্ছি, আর স্টার পাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না । এবার ওপরওয়ালা বোধহয় অন্য কিছু ভেবেছিলেন আমার জন্য । রেজাল্ট বেরোলো ইংরাজি এর দ্বিতীয় পত্রে মাএ ৫০! , কেমিস্ট্রি তে ৭০! সবমিলিয়ে মাএ ৭২ শতাংশ । সেদিন খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। আজও ইংলিশ আর কেমিস্ট্রি এর রেজাল্ট আমার কাছে রহস্য বলে মনে হয়! যাই হোক জীবন যুদ্ধে হার জিত থাকবেই , সে নিয়েই চলতে হবে। অন্যদিকে চন্দন যে কিনা আমার সাথে tenpur এ পড়তো সেও ভালো রেজাল্ট করতে পারলো না সেও first division পেয়েছিল, আমার থেকে একটু কম । এরপর তিন বন্ধু ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো সোজা কোথায় ডিভোর্স! আমি বাগনান কলেজ এ কেমিস্ট্রি , চন্দন আমতা রমসদয় কলেজে ফিজিক্স, সুব্রত উলুবেড়িয়া কলেজে ফিজিক্স নিয়ে ভরতি হলাম|
এরপর শুরু হলো অন্য লড়াই । কি পড়বো? কোন্ লাইনে এ গেলে প্রতিষ্ঠিত হবো সেই ভাবতে ভাবতে কিছুদিন চলে গেলো। তারপর আমার প্রিয় বিষয় কেমিস্ট্রি নিয়ে বাগনান কলেজে ভর্তি হলাম। ধুর কলেজ জীবন ভালো লাগলো না, ছেড়ে দিলাম! সবাই বললো খুব ভুল করলে। বাগনান এর কেমিস্ট্রি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি এর মধ্যেঅন্যতম সেরা । আবার গেলাম কলেজে , মন টিকলো না, ছেড়ে দিলাম । তারপর এ বললো ওটা পড় , সে বলছে এইটা পড় । সোজা কোথায় ঠিকঠাক গাইডেন্স টা পাচ্ছিলাম না । এরপর সব ছেড়েছুড়ে joint এ বসবো ঠিক করলাম , গেলাম কলকাতার একটা কোচিং সেন্টারে mock test জন্য ভর্তি হলাম। দিলাম joint medical , নাম এলো না! ওদিকে চন্দন ইঞ্জিনিয়ারিং ইলেকট্রিক্যাল নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলো আমি ব্যার্থ মনোরথে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম , খোঁজ শুরু করলাম কোথায় ভালো মেডিকেল এর কোচিং পাওয়া যাবে! আসলে সেই সময় একটা মুভি আমার জীবনটাকে অনেকটাই বদলে দিয়েছিল তা হলো মহানায়ক উত্তমকুমার এর ‘অগ্নিশ্বর’ । অন্তত ৮-১০ বার দেখেছি মুভি টা , এই মুভি টা আমার জীবন দর্শনটাকে বদলে দিয়েছিল । আসলে ডাক্তার হবার নেশা তখন পেয়ে বসেছে ।যাই হোক এ বললো ওখানে যাও সে বললো অমুকের কাছে যাও মেডিকেল এর প্রস্তুতি নিতে । আমি সম্পূর্ন বিভ্রান্ত।তখন বুঝেছিলাম ডাক্তারহীন পরিবার থেকে ডাক্তার হওয়া টা কতটা কঠিন । এদিকে চারদিকে সমালোচনার ঝড়, কেমিস্ট্রি ছাড়া, joint না পাওয়া। সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা । যাই হোক তারপর ঠিক করলাম মেডিকেল এর সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং টাও দেবো, যাতে মেডিকেল টা না পেলেও ইঞ্জিনিয়ারিং টা পেয়ে কিছুতেই মুখরক্ষা হয় । আবার জইন্তে দিলাম এবারেও মেডিকেল হলো না , ইঞ্জিনিয়ারিং chance পেলাম মোটামুটি rank হলো। সবাই বললো ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়ে যেতে , মধ্যবিত্ত ঘরে তখন ডাক্তার হওয়া ব্যাপারটা অনেকটা লটারির টিকিট কাটার মত ব্যাপার ছিল আর কি! তাই অনিচ্ছা সত্বেও Leather technology College (govt college) তথ্য প্রযুক্তিতে B tech পড়তে ভর্তি হলাম । মন টিকলো না , নানা ফন্দী ফকির করে আবার পালিয়ে এলাম ডাক্তারী পড়তে ! এবার গন্তব্য Rainbow coaching center, medical এর কোচিং নিতে । সব সমালোচনা কে তুচ্ছ করে এবারে ডাক্তারী তে চান্স পেলাম। সে দিন খুব খুশি হয়েছিলাম , কারন যারা আমায় এতদিন সমালোচনা করেছিল তারাই ১৮০ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে আমায় অভিনন্দন জানিয়েছিল। তারপর উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ঘুরে topper হিসাবে মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে এ ভর্তি হলাম ।
মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে আমার ডাক্তারী জীবনের অনেকটা ভালো অনেকটা খারাপ সময় কাটিয়েছি। যে sir এর সান্নিধ্যে না এলে আমার এখনও পর্যন্ত ডাক্তারী জীবনটাই অপূর্ণ থাকতো সে হলো কলকাতা মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন এর প্রাক্তন হেড Dr. Salil Bhattachary । এ ছাড়া যে sir দের সান্নিধ্য আমার ডাক্তারী জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে তাদের অন্যতম হল পিজি হসপিটাল এর biochemistry এর হেড Dr. Sasanka chakraborty, microbiology এর হেড Dr.PN Gupta। যাই হোক এর ২০১১ তে ইন্টার্নশিপ শেষ করে ভগ্ন মনোরথে মেদিনীপুর ছাড়লাম , গেলাম কলকাতার চিত্তরঞ্জন শিশু সদন হসপিটাল এ । এখানেই এখনও পর্যন্ত আমার ডাক্তারির সেরা সময়টা কাটিয়েছি Dr Madhusmita ম্যাডাম এর অধীনে । এখনও পর্যন্ত শিশু চিকিৎসার যা টুকু শিখেছি তা ওই ম্যাডামের অধীনে সিনিয়র রুদ্রদা, সমীরণদা, কৌশিকদা , dona দি এর সৌজন্যে। সাথে ছিলো আমার বেস্ট friend Dr. নির্মাল্য । দুজনের কতো সুখ স্মৃতি এই শিশু সদনে জড়িয়ে আছে তা শুরু করলে আর শেষ করা যাবে না । যাই হোক তারপর একদিন শিশু সদন ছেড়ে কর্পোরেট hospital এ যোগদান করলাম । অনেক কিছু দেখলাম সেখানে, মেনে নিতে পারলাম না । তাই সরকারী হসপিটাল এ join করলাম আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কিছু করবো বলে । এরপর বাকি গল্প ও জীবনযুদ্ধের লড়াই ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখলাম——-